"শতাব্দীর জননেতা: মাওলানা ভাসানী" বইটির রিভিউ:
বাংলাদেশের রাজনীতির আলোচনা আমরা প্রায়ই চা-পান কিংবা বন্ধুদের আড্ডায় করে থাকি। যদিও আমাদের সবার জ্ঞানের গভীরতা প্রখর রাজনীতিবিদদের মতো নয়, তবে আমরা অনেকেই প্রিয় দল বা নেতাকে যুক্তি-তর্কে এগিয়ে রাখার চেষ্টা করি। আবার অনেকেই রাজনীতিতে সরাসরি আগ্রহ না থাকলেও পাবলো নেরুদা, কার্ল মার্ক্স বা চে গুয়েভারার আদর্শ ও সমাজব্যবস্থার প্রতি আকর্ষণ বোধ করি। তবে বিশেষ কিছু মানুষের জীবন জানতে ও তাদের সম্পর্কে আলোচনা করতে অনেকেরই ভালো লাগে। যেমন লাল ঘোড়া সিরাজ শিকদার, মাওলানা ভাসানী — যারা আমাদের রাজনীতির আলোচনায় খুব একটা উঠে আসে না। তাদের সম্পর্কে দু-একটি উদ্ধৃতি মাঝে মাঝে শোনা গেলেও গভীরভাবে বিশ্লেষণ বা আলোচনা সেভাবে শুনিনি।
মাওলানা ভাসানী সম্পর্কে অনেক গল্প ও উদ্ধৃতি শুনেছি। সম্প্রতি, যখন আ ন ম আবদুস সোবহানের লেখা "শতাব্দীর জননেতা: মাওলানা ভাসানী" বইটি পড়লাম, মনে হলো আমাদের রাজনীতির আলোচনায় যারা তর্কে-গলায় ভরসা করে বড়াই করে, তারা ভাসানীর মতো এক সাধারণ মাওলানার সামনে একেবারেই শিশু। তার কথা বলার ধরন, সাদামাটা পোশাক আর চলন-বলনের মধ্যেও কত গভীর সৃজনশীল চিন্তা ফুটে ওঠে! চে গুয়েভারার বই পড়ে যতটা মুগ্ধতা অনুভব করেছিলাম, তার চেয়েও বেশি মুগ্ধ হয়েছি এই বইটি পড়ে। এটি যেন এক দেহমনে জাগানো অনুভূতি।
"শতাব্দীর জননেতা: মাওলানা ভাসানী" বইটি মূলত মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর জীবন, সংগ্রাম এবং নেতৃত্বের বিভিন্ন দিককে চিত্রিত করেছে। উপমহাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে মাওলানা ভাসানীর বিপ্লবী ভূমিকা, তার সাধারণ মানুষের প্রতি আত্মনিবেদন এবং সাহসিকতার অসাধারণ গুণাবলী এই বইয়ে চমৎকারভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। তিনি ছিলেন বিরল এক নেতা, যিনি আমৃত্যু শোষিত ও বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তার জীবন ও আদর্শের বিশদ বিবরণ বইটিকে এক অনন্য মর্যাদায় উন্নীত করেছে।
বইটিতে ভাসানীর ব্যক্তিত্বের বৈচিত্র্য এবং তার গভীর চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলার পাশাপাশি তার নেতৃত্বের দৃঢ়তা, নীতিগত কঠোরতা, এবং রাজনৈতিক দূরদর্শিতার এক বিস্ময়কর বিশ্লেষণ উপস্থাপন করা হয়েছে। লেখক সহজ, প্রাঞ্জল ভাষায় ও গবেষণালব্ধ তথ্যের আলোকে তার কর্মময় জীবন, মানবিক গুণাবলী এবং সাধারণ মানুষের জন্য ত্যাগের নানা অধ্যায়কে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। বইটির প্রতিটি অধ্যায়ে ভাসানীর জীবন ও আদর্শের এমন সব দিক উঠে এসেছে যা তাকে নিছক একজন রাজনীতিবিদ নয়, বরং উপমহাদেশের একজন মহান নেতা ও মজলুম জননেতা হিসেবে পরিচিত করেছে।
বইটির লেখনী সহজবোধ্য ও প্রাঞ্জল, যা যেকোনো পাঠককে মুগ্ধ করবে এবং মাওলানা ভাসানীর জীবনের শিক্ষাগুলো সম্পর্কে ভাবতে অনুপ্রাণিত করবে। বিশেষ করে, তার পোশাক ও সহজাত ভঙ্গিমার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের সঙ্গে তার সংযোগ স্থাপনের সরলতা এবং বক্তৃতায় গভীর দৃষ্টিভঙ্গি অনেক পাঠকের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠবে। বইটি মাওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক আন্দোলন, তার আপসহীন মনোভাব ও শোষিত মানুষের প্রতি গভীর মমত্ববোধকে চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছে, যা তার মজলুম জননেতা হয়ে ওঠার পেছনে শক্ত ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে।
সব মিলিয়ে, "শতাব্দীর জননেতা: মাওলানা ভাসানী" একটি অবিস্মরণীয় গ্রন্থ। এটি শুধু একটি জীবনী নয়; বরং সংগ্রামী এক নেতার প্রতি একটি শ্রদ্ধাঞ্জলি, যা ইতিহাসের মহানায়ককে জানার, তার জীবন থেকে শিক্ষা নেওয়ার এবং তার সমাজের প্রতি অবদানের স্মৃতিচারণ করার এক অতুলনীয় উপায়।


Comments
Post a Comment